অর্থশাস্ত্র ওর মাঝেই আছে
✳ শিবানন্দ পাল
➡ "দিল্লি থেকে তখন এক টাকা পাঠালে গরিব মানুষের কাছে পৌছাতো মাত্র ১৫ পয়সা বুঝলি! আর এখন চার চাকার ভলভো বাস পাঠালে গরিবের ঘরে এসে পৌছায় তিন চাকার ছ্যাকরা গাড়ি।" বাদলা উম্পুন সকালে পাগলা বললো।
বললাম কাল আমাকে খুব অর্থনীতি শিখিয়েছিস। আজ উম্পুনের ১৩৩ কিলোমিটারের ঝড়ে সব উড়ে গিয়েছে।
পাগলা বলল, আজ তোকে অর্থশাস্ত্র বোঝাবো।
মানে?
কৌটিল্যের 'অর্থশাস্ত্র’! ২২০০ বছর আগে লেখা এই বই ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন রাষ্ট্রনীতির গ্রন্থ। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনকালে এই বই রচিত হয়েছিল। প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি ও শাসনসংস্কারের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য দলিল। রাজ্যশাসন, শত্রুদমন, রাজস্ব আদায়, দেওয়ানি-ফৌজদারি আইন, পৌর প্রশাসন সব বিষয় এই বইয়ে আলোচিত হয়েছে।
অর্থশাস্ত্র নাম একখানা শুনেছি বটে!
পণ্ডিতরা বলেন, অর্থশাস্ত্রের বক্তব্য খুব পরিষ্কার আর স্ববিরোধিতা মুক্ত। অর্থশাস্ত্র সেযুগে বলেছে গণজীবনের শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা হচ্ছে বিশুদ্ধ রাজতন্ত্র। গণজীবনের সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থাকবে। সে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন হোক আর নারীর স্বাধীকার, বিচার ব্যবস্থা সবকিছুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
দূর এতো বামপন্থীদের মতো কথা বলছিস?
শুনতে ওরকমই মনে হচ্ছে। অর্থশাস্ত্রে লিখেছে
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের স্বার্থে রাজকর্মচারী নিয়োগকালে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, কৃষির উন্নতিকল্পে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কৃষকদের উৎকৃষ্ট বীজ ও সার সরবরাহ করতে হবে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে, জমির উপর চাষির ন্যায্য অধিকার স্বীকার করতে হবে রাষ্ট্রকে। সমাজে নারীর বিশেষ অধিকার থাকবে, বিবাহ বিচ্ছেদ ও বিধবা বিবাহের বিধান থাকবে, ব্রাহ্মণের বিশেষ অধিকার বলে কিছু থাকবে না, অপরাধ অনুসারে ব্রাহ্মণেরও প্রাণদণ্ডের বিধান হতে পারে ... এমন সবকিছুই অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে।
এতো সাংঘাতিক ব্যাপার দেখছি!
অনেকেই স্বীকার করেছেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে কৌটিল্যের মন্তব্যগুলো যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বগুলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আধুনিক শিক্ষক ইতালির বিশিষ্ট রাষ্ট্রনীতিবিদ ম্যাকিয়াভেলির সঙ্গে তুলনা করা হয়।
ইতালিয় রেনেসাঁসের অন্যতম পুরোধা ম্যাকিয়াভেলি? যিনি ১৫১৩ সালে ফ্লোরেন্সের তৎকালীন রাজা পিয়ারো ডি মেডিচির পুত্র প্রিন্স লরেঞ্জোর জন্য উপদেশমূলক গ্রন্থ 'দ্য প্রিন্স' লিখেছিলেন!
হ্যাঁ। পরিবর্তনের রূপকার ম্যাকিয়াভেলি।লরেঞ্জো যদিও সেই উপদেশ গ্রহণ করেনি। কিন্তু পরবর্তীকালে দুনিয়ার সব স্বৈরশাসক তাঁরা সেই বইকে গুরুত্ব দিয়েছে। মুসোলিনি এই বইয়ের একটি সংস্করণে ভূমিকা লিখেছিলেন। হিটলার তাঁর বিছানার পাশে এক কপি রেখে দিতেন।
বলিসকি? আমাদের নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি তেমন কিছু করেন নাকি?
পাগলা বলে, জানা নেই। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্র-সমাজ ও ধর্ম ছাড়াও আছে জীবজগত তথা উদ্ভিদ জগতের সাথে মানুষের সম্পর্ক, খনিজ পদার্থ ও বিভিন্ন ধাতুর ব্যবহার প্রক্রিয়া, ভূতত্ত্ব, কৃষি, পশুপালন এরকম ১৮০ টা বিষয়।
কার্লমার্কস এ বইটা পড়েননি তো?
উনি কী সংস্কৃত জানতেন নাকি?
তা জানি না।
অর্থশাস্ত্র এমন বহু বিষয়ে জ্ঞানের আধার হওয়ায় অনেকের ধারণা এককভাবে এই বই কৌটিল্যের রচনা নয়। সম্ভবত তিন চার শতক ধরে এই বই রচিত হয়েছে দিয়ে এই চেহারা পেয়েছে। এই বই থেকে প্রাচীন ভারতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবস্থান সম্পর্কে অনেক কিছু
জানা সম্ভব হয়েছে।
জ্ঞান বিজ্ঞান? সবটাই তো সেসময় অপবিজ্ঞান!
অপ নয়, উপও নয়। অর্থশাস্ত্রকে আরো একটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
আবার কি?
প্রাচীন ভারতে যত বই পাওয়া গেছে প্রায় সবেতেই পরজাগতিক বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে।অর্থশাস্ত্রে কেবল সবকিছু ইহজাগতিক, পার্থিব বিষয় আলোচিত হয়েছে। পণ্ডিতরা সেজন্য বলেন অর্থশাস্ত্রে আলোচিত তত্ত্বসমূহ বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রসূত তথ্য।
হতেই পারে গুপ্ত সাম্রাজ্যে ভারতের রাস্তাঘাট, শাসনব্যবস্থা অনেক উন্নত ছিল।
আশ্চর্যের বিষয় কি জানিস? কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আমাদের এই বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।
কী রকম?
তৎকালীন সর্বভারতীয় বাজারে বাংলার সুক্ষ্ম সূতীবস্ত্রের চাহিদা ছিল। আর ... !
আর কী?
গোটা ভারতবর্ষের মেয়েদের মধ্যে বাংলার নারীর রূপ-লাবণ্যের কথা বলা হয়েছে শ্রেষ্ঠ।
বলিসকি? সোনার দেশ! সোনার ফসল! আবার সোনার বরণ রূপসী, কুঁচবরণ কেশ! কি যেন গানটা ... সোনার হাতে সোনার কাঙ্কন ... কে কার অলঙ্কার ... আহা!
গুপ্ত সাম্রাজ্য মানে এখন যাকে আমরা ভারত উপমহাদেশ বলে চিহ্নিত করি। বুঝেছিস ব্যাপারটা? যাকগে, আমরা অর্থশাস্ত্রের আলোচনায় ফিরি।
পাগলা বললো, অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কৌটিল্য ছিলেন মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ছিলেন অতীব বুদ্ধিমান। সেজন্য তাঁকে বলা হতো ‘চাণক্য’। আবার তিনিই ছিলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রাথমিক জীবনের শিক্ষক। সংস্কৃত ভাষায় রচিত এই গ্রন্থ দক্ষিণ ভারতের এক নিভৃত স্থান থেকে উদ্ধার করেন পন্ডিত শামশাস্ত্রী।
বেশ!
১৯১৫ সালে তিনি এই গ্রন্থ সম্পাদনা করে মূল অংশের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। সম্পূর্ণ বই ১৫ টি ভাগে বিভক্ত। ভাগগুলোকে ‘অধিকরণ’ বলা হয়। মোট শ্লোক আছে ৬,০০০।
৬০০০ শ্লোক!
ভারতের সংবিধানের এক একটা ধারা যেমন এক একটা অনুশাসন। ঠিক তেমনি অর্থশাস্ত্রের এক একটা শ্লোক আমাদের ওই রকম বার্তা দেয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে 'জনসাধারণের স্বভাবদোষ ও বিপর্যয় প্রসঙ্গে' কয়েকটি শ্লোক আছে। কয়েকটা বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়―
(১) কোন এক নির্দিষ্ট বিষয়ের বিপর্যয় যদি সমাজের অন্য সমস্ত বিষয়কে গ্রাস করে, তাহলে সেটা হয় ভয়ঙ্কর। খুব তাড়াতাড়ি সেটির বিনাশ অথবা সমাধান দরকার।
(২) অন্ধ রাজা এবং বিজ্ঞানবিরোধী রাজার তুলনায় অন্ধ রাজা ভাল। কারণ অন্ধ রাজার সঙ্গীরা তাঁকে ভাল পরামর্শ দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু বিজ্ঞানবিরোধী রাজা অবিবেচকের মত গোটা সমাজটাকেই ধ্বংস করে দেবে।
(৩) বিপর্যয়ের সময় অসচেতনতা এবং বিশৃঙ্খলা সাধারণ মানুষের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে।
(৪) বিপর্যয়ের সময় মদে আসক্তি মানে নেশায় আসক্তি মানুষের বাহ্যজ্ঞান লোপ করে দেয়।
(৫) মহামারী এবং দুর্ভিক্ষের তুলনায় দুর্ভিক্ষ বেশি ধ্বংসাত্মক। কারণ মহামারী সমাজের গোটা অংশকে স্পর্শ করে না। কিন্তু দুর্ভিক্ষ গোটা সমাজকে আক্রান্ত করে।
(৬) কোন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে উপার্জিত অর্থ কোষাগারে সযত্নে জমা হওয়া উচিৎ যাতে আপৎকালীন সময়ে তা ক্ষতিগ্রস্থ সাধারণ মানুষের কাজে আসে।
বেশী উদাহরণ দিতে চাই না। এই ছ'টা কথা বললাম কেন জানিস?
কেন?
আমাদের দেশের সরকার ... মানে কেন্দ্রীয় সরকার যে দল পরিচালনা করে তারা তো খুব হিন্দুত্ব ফলায় ... রামরাজ্য তৈরি করবো বলে ... সেজন্য। দেশের এখন আপৎকালীন সময়। চারদিকে বিপর্যয়। এই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পেতে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রই এখন টোটকা। তুই কী বলিস?
পাগলা আমাকে জিজ্ঞেস করলো! কী উত্তর দেব বলুন তো আপনারা? বললাম, তা তুই আমাদের দিদির ব্যাপারে কিছু বললি না?
পাগলা বললো, ওনার তো বেদ থেকে বাইবেল সব মুখস্থ। অর্থশাস্ত্র ওর মাঝেই আছে।
় কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অভিজিৎ মিত্র