চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

আমার মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা

আমার মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা

 ✳ শিবানন্দ পাল

 ➡ বরাক নদীর উপত্যকা। দিনটা ছিল ১৯৬১ সালের ১৯ মে। শিলচর স্টেশন সংলগ্ন এলাকা। ইতিউতি ছড়িয়ে ছিল ৯ জন মানুষের  গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। পরের দিন হাসপাতালে মারা যায় আরও দুজন। এই এগারো জন স্বাধীন ভারতে বাংলা ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন। এঁদের দাবি ছিল আসামে অহমিয়ার পাশাপাশি অন্যতম সরকারি ভাষা হোক বাংলা ভাষা।

অনেকেই বলেন একুশ তোমার চেতনা, উনিশ আমার প্রেরণা! একুশ ১৯৫২- র ঘটনা, উনিশ, ১৯৬১-র। মূল বিষয় অবিচ্ছেদ্য। মাতৃভাষার দাবি। সাম্রাজ্যবাদীদের নিখুঁত কূটকৌশলের ফল বাংলা মনন জগতকে করেছে দ্বিখণ্ডিত। একুশ হয়েছে তোমার, উনিশ আমার। তোমার আমার দ্বন্দ্বে চাপা পড়ে গেছে স্কুল ছাত্রী ষোল বছরের বালিকা কমলা ভট্টাচার্য‌‌। যিনি ওই এগারো জন শহীদদের মধ্যে অন্যতমা।

আসামের বিপুল পরিমাণ বাঙালির নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার অর্জনের দাবি সেটাও ছিল অনেক পুরনো। বরাক উপত্যকার হাইলাকান্দি-করিমগঞ্জ-শিলচর তিনটি জায়গা তখনকার মতো এখনো বাংলাভাষীদের প্রাধান্য। এই ইতিহাস খুঁজতে গেলে যেতে হবে মোগল আমলেরও আগে।

সে অন্য কথা! আজ শুধু ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবার দিন।
উনিশের সকাল। রাত ভোর হলেই তুমি আসবে। বসে আছি তারই প্রতীক্ষায়...

রাত পার হলেই যেমন অন্য দিনগুলো আসে!
নানা দেশের নানান ভাষার বিকাশের আকাঙ্খায় মাতৃভাষার স্বাধিকারের দিন বলে জানি। আমাদের বাংলা ভাষা। আহা মরি! কিন্তু বাংলা ভাষার হিসেবেই বিজয়ীর শিরোপা ইংরাজীর একুশের। অদ্ভুত ব্যাপারটা। মাঝে মাঝে লাগে তাই খটকা! এও কী সাম্রাজ্যবাদীদের নিখুঁত কূটকৌশল নয়তো?

কে যেন হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল প্রথম পাঠশালায়। ভাঙ্গা বাঁশের খুঁটি, খড়ো চালের সেই ঘরের দাওয়ায় একটি বালিকা বর্ণ পরিচয়ের খোলা পাতায় আঙ্গুল ডুবিয়ে চুপ করে বসেছিল, চোখের জলে কান্না ভেজা মুখ তার।

'ছোটো খোকা বলে অ আ শেখেনি সে কথা ক‌ওয়া।' ভাষার মধ্যে প্রবেশ আমার সেখানেই।

গুরু মশাই বলেছিলেন, ভাষাটা ভালো করে শেখো বুঝলে! এটাই হলো আসল চাবিকাঠি! নিজের ভাষা ভুলে যাওয়া মানে কারাগারের চাবিটা হারিয়ে ফেলা। নিজেকে কূপমণ্ডুক তৈরি করা।

কারাগারের মানে তখন বুঝিনি কিছু। একটু একটু করে জেনেছিলাম যারা স্বাধীন দেশে শোষকতন্ত্রের অবসান চায় তাঁদের যেখানে বন্দী করে রাখা হয়, সেটাই হলো কারাগার।

কিন্তু বাংলা ভাষার সাথে কারাগারের সম্পর্ক কী জেনেছি আরও অনেক পরে। ভালো করে জানলাম পরিনত বয়সে যেদিন ভাষার জন্য এক নদী রক্তাক্ত বিনিময়ে একটি রাষ্ট্রের জন্ম হল।

স্বাধীন বাংলাদেশ। পায়রাগুলো উড়ে উড়ে আপন মনে গান গাইছিল, একটি বিশেষ ছন্দে, একটি মিষ্টি মধুর সুরে।

আজ কিন্তু মনে হয়, আমার জন্ম পরিচয় বাঙালি হয়তো থাকবে। কিন্তু বাংলা ভাষা পরিচয় ...কী থাকবে? স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় হয়তো সবই থাকবে। কিন্তু ভাষাটা?

এখনও তো বাংলা বিহার ওড়িশা ঝাড়খণ্ড এমনকি দিল্লি সব জায়গায় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ছিল তেমনই আছে। বরং আরো বেড়েছে ... কিন্তু বাংলা ভাষা?

আসলে কোথায় শ্রদ্ধা জানাবো সেই জায়গাটা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাষা হল সেই ভূমি। ভূমিকে দখলে নিতে হলে ভাষার দখল চাই। তাই ভাষার উপরে আক্রমণ হয়। তাকে যথেষ্ট দুর্বল করা, শিকড় উপড়ে ফেলা, সিঞ্চন বন্ধ করা ... এসবই সাম্রাজ্যবাদীদের নিখুঁত কূটকৌশলের অংশ। আর এসব করতে পারলেই ....

গুরুমশাই ঠিকই বলেছিলেন, ভাষা কারাগারের চাবিকাঠিও বটে। মাতৃভাষা যতক্ষণ মুঠোয় ধরা থাকে, কয়েদখানার চাবিও থাকে হাতের মুঠোয়। ইচ্ছেমত বাইরে আসা যাওয়া চলে। অন্য ভাষার অন্দরেও প্রবেশে বাধা থাকে না।

ভাষা যেমন সাহিত্য তৈরি করে, তৈরি করে একটি জাতি। তাই লেনিন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণ পর্বে 'লেখন ও কথন'-এর যথাযথ মাধ্যম গড়ে তুলবার লক্ষ্যে যথেষ্ট যত্নশীল হতে বলেছিলেন। যাতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রচারকদের সংগে জনগণের সেতুবন্ধন সহজতর ও উপযুক্ত হয়। অথচ ইংরাজিতে পণ্ডিত বাংলা লিখতে পড়তে না জানা- এই গৌরবের কাল চলে আসছে আমাদের বঙ্কিমের যুগ থেকে।

ভাষা মার খাচ্ছে, ভাষা মারা যাচ্ছে। বৎসরান্তে শুধু একটি দিন সে উনিশ হোক আর একুশ তারজন্যে মিছিল, সভা, সমাবেশ করে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। যদি না সংসার সীমান্তে তাকে আমরা মায়ের মত শ্রদ্ধা করতে না পারি। বলতে পারি আমার মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা।