চৈতন্য মহাপ্রভু'র নামে নব নির্মিত তোরণ উদ্বোধন কাটোয়ার দাঁইহাটে

টুকরো কথায় সত্যজিৎ

টুকরো কথায় সত্যজিৎ

✳ প্রতনু রক্ষিত

 ➡ সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গে বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা আকিরা কুরোসাওয়ার একটি বিখ্যাত উক্তি করেছিলেন -‘সত্যজিতের চলচ্চিত্র না দেখা আর পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্য না দেখা একই কথা’।
আমরা যদি শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের তালিকা খুঁজি, তাহলে রবীন্দ্রনাথের পরেই যাঁর নাম পাওয়া যাবে, তিনি হলেন আমাদের সত্যজিৎ রায়। বলা যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছাড়া যেমন বাংলা সাহিত্যে অসম্পূর্ণ, ঠিক তেমনি সত্যজিৎ রায় ছাড়া অসম্পূর্ণ বাংলার সিনেমা জগৎ।
সালটা ১৯৫৫ তারিখটা ২৬ শে আগস্ট বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এক বিপ্লব ঘটিয়ে মুক্তি পেল কালজয়ী ' পথের পাঁচালী'। আগা গোড়া নতুনত্বের মোড়কে আবৃত এই চলচ্চিত্র, সমালোচকদের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দিলো। প্রত্যেকটি চরিত্র যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দিল দর্শকদের মনে। আর মিউজিক! এক কথায় দুর্দান্ত, যা চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপটকে সুনিপুণ ভাবে তুলে ধরেছিলো প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয়ে।
তবে চলচ্চিত্রের অনেকগুলো অভিনবত্বের মধ্যে অন্যতম ছিল 'টাইটেল কার্ড'। যেগুলিকে সত্যজিৎ রায় নিজের হাতে আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়েছিলেন। এতদিন পর্যন্ত দর্শকেরা আলপনা, ফুল ইত্যাদির ধাঁচে ফুল পেজের মোটিফ দিয়ে নামলিপি দেখতেই  অভ্যস্থ ছিল, কিন্তু এবার তারা দেখলো পুঁথির স্ক্রিপ্টের ধরন ও অদ্ভূত সব ক্যালিগ্রাফি; যেটা আগে থেকেই সিনেমার মুড তৈরি করে দেয়।
সত্যজিত রায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র 'পথের পাঁচালী' মোট ১১ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পায়। আসলে কেউ যখন মন প্রাণ দিয়ে কিছু সৃষ্টি করে, সেটা অবশ্যই সফলতার শীর্ষে পৌঁছায়। এক্ষেত্রেও অন্যথা হয় নি। ছোটবেলা থেকেই তাঁর সখ ছিল জার্মানি থেকে শিখে  সিনেমা বানানোর। শৈশবের এই সখ কৌতুহল ও উৎসাহে পরিনত হয় যখন তিনি শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ রেনোয়ার সংস্পর্শে আসেন। এর পর ইতালীয় পরিচালকের 'বাইসাইকেল থিফ' ছবিটি তাঁকে আরো প্রভাবিত করে।
'পথের পাঁচালী'  অনেকের মনেই সিগনেট থেকে প্রকাশিত 'টুকরো কথা'র স্মৃতিকে উস্কে দিয়েছিলো। ১৯৪৩ সাল সত্যজিতের বয়স তখন প্রায় ২৩, শান্তিনিকেতন থেকে ( পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে) সবে ফিরেছেন কলকাতায।  ফিরে তিনি চাকরি নেন কিমার বিজ্ঞাপন সংস্থায় একজন ভিশুয়ালাইজার হিসাবে।
পরবর্তী সময় তিনি কিমার কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার দিলীপকুমার গুপ্তের ( যিনি ডি.কে নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন) সংস্পর্শে আসেন। জহুরীর চোখ সোনা চিনতে ভুল করেনি। নিজের স্বপ্ন পূরণের দোসর হিসাবে সত্যজিতকে পেয়ে ডি.কে সিগনেট প্রেসের( ১৯৪৪ স্থাপিত) কিছুটা দায়িত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দেন। একজন স্থায়ী আর্টিস্ট হিসাবে সিগনেট প্রেসের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন, বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সত্যজিতের প্রতিভার সুবাস ছড়াতে শুরু করে।
 উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার আর অবনীন্দ্রনাথের শিশু সাহিত্য প্রকাশ করার কথা হয় এই প্রেসের মাধ্যমে।১৯৪৪ থেকে ১৯৭৫, এই চার দশকে ১৩১টি বই বেরিয়েছে সিগনেট থেকে। এর মধ্যে আটটি বই মুদ্রণ, বাঁধাই বিভাগে সর্ব ভারতীয় পুরস্কার জিতেছে। ১৯৪৫-এ জহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ প্রথম ছেপেছিল সিগনেটই।
এরপর ১৯৫০ সালে এই প্রেস থেকে আত্মপ্রকাশ করে এক বিশেষ বিবৃতিপত্র, যার উদ্দেশ্য ছিলো প্রকাশিত বা প্রকাশ পাবে এমন বইয়ের পরিচয় সহজে অল্প কথায় প্রকাশ করা। তবে শুধুমাত্র যে সিগনেট থেকেই প্রকাশিত বইগুলোর আলোচনা এখানে ছাপা হবে, এমনটা কিন্তু ছিল না। আসলে ডি.কে চেয়েছিলেন পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকের মধ্যে একটা মেলবন্ধন তৈরি করতে।
এই বিবৃতি পত্র লেখার দায়িত্ব পড়ে প্রখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক নরেশ গুহের উপর ( তবে অন্তিম সংখ্যার লেখক ছিলেন প্রাবন্ধিক নৃপেন্দ্র সান্যাল) আর সাজানোর দায়িত্ব পড়ে সত্যজিৎ রায়ের উপর।
এই বিবৃতি পত্রের আত্মপ্রকাশ সংখ্যার নাম ছিলো 'পান্ডুলিপি'। যেখানে লেখা হলো সুকুমার রায়ের 'খাই খাই' বইটির কথা। তবে পরবর্তী সংখ্যার নাম সত্যজিৎ রায় পরিবর্তন করে রাখলেন 'টুকরো কথা'। এরপর প্রায় ৩৯ তম সংখ্যা পর্যন্ত বিবৃতি পত্রের নাম অপরিবর্তিত থেকে যায়।
এই 'টুকরো কথা'তে থাকতো সত্যজিৎ রায়ের আঁকা সুন্দর সুন্দর চিত্র, অসাধারণ বিজ্ঞাপন অঙ্কন, ( যা টেলপিস নামে পরিচিত ছিলো)। সোজাসুজি এক একটা বাক্যকে এক একটা ছবি করে তোলার মুন্সীয়ানা তিনি দেখিয়েছিলেন। কখনো তিনি এক ভদ্রলোকের চিত্রকে দিক নির্দেশক কম্পাসের মতো ব্যবহার করেছিলেন, তো কখনো আবার পাখির বুলির মাধ্যমে বা ঘোমটা দেওয়া বধূর মাধ্যমে সহজ ভাবে আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে বিজ্ঞাপনের কথা তুলে ধরেছিলেন এই পত্রে।
 'পথের পাঁচালী' এর অনেক দৃশ্য সত্যজিৎ রায় আগে ভাগেই 'টুকরো কথা'য় এঁকে ফেলেছিলেন। মানে দীর্ঘদিন আগে থেকেই এই চলচ্চিত্র বানানোর পরিকল্পনা তাঁর মস্তিষ্কে স্তরে স্তরে তৈরি হয়েছিল। তিনি সময়মতো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধবা স্ত্রী রমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে দশ হাজার টাকার বিনিময়ে পথের পাঁচালীর স্বত্ব ক্রয় করে রাখেন।  প্রায় সাত বছর ধরে প্রকাশিত ৪৪টি 'টুকরো কথা'তেই সত্যজিৎ রায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতির প্রমাণ দিয়ে গেছেন।
এইসব কারণে 'টুকরো কথা'র চাহিদা সেইসময়ে তুঙ্গে উঠেছিলো। বিশুদ্ধ বঙ্গীয় মোটিফের অলঙ্কৃত প্রচ্ছদ, হাতের লেখার ধাঁচে বইয়ের নাম এবং সর্বোপরি ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির উর্ধ্বে থাকা ডি. কে এর মানসিকতা এই বিশাল জনপ্রিয়তায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলো।
'টুকরো কথা'র ৪২ তম ও ৪৩ তম সংখ্যায় দুটি উল্লেখযোগ্য সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওই সময়েই ভারত সরকার প্রকাশন ও মুদ্রন কর্মের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যে প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন, সেখানে হাজারের কাছাকাছি মুদ্রিত গ্রন্থের মধ্যে শিল্পী হিসেবে প্রথম পুরস্কার অর্জন করেন সত্যজিৎ রায়, 'খাই খাই' বইয়ে ছবি আঁকার জন্য। এই আনন্দ সংবাদটি ছাপা হয় ৪২ তম সংখ্যায়।
আর ৪৩ তম সংখ্যায় ছাপা হয় আন্তর্জাতিক গ্রন্থ প্রচ্ছদ প্রদর্শনীতে সত্যজিতের স্বর্ণ পদক প্রাপ্তির সংবাদ।
এর পরে তিনি অপরাজিত ও পরশপাথর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি। সারা জীবনে তিনি মোট ৩৬টি ছবি পরিচালনা করেন। এর মধ্যে ২৯টি ছিল কাহিনিচিত্র, পাঁচটি তথ্যচিত্র ও দু’টি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি।
সত্যজিৎ রায় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতে এবং অন্যত্র অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার পাওয়া এই পুরস্কারগুলির মধ্যে অন্যতম ভারতের একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র।১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার অর্জন করেন। এরপর ১৯৯২ সালে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন লাভ করেন। পরিচালনাসহ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন শাখায় অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯১ সালে অস্কার কমিটি তাঁকে আজীবন সম্মাননা পুরষ্কার প্রদান করে।
বাংলা, ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে এই মহান চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, সাহিত্যিক, সঙ্গীত পরিচালক, গীতিকার, চিত্রকর, গ্রাফিক্স ডিজাইনারের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।